রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

কবি মানিক বৈরাগীর ৫২তম জন্মদিনে বিশেষ ক্রোড়পত্র : “প্রত্যাশা”

শনিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩
874 ভিউ
কবি মানিক বৈরাগীর ৫২তম জন্মদিনে বিশেষ ক্রোড়পত্র : “প্রত্যাশা”

কক্সবাংলা ডটকম(২৮ জানুয়ারি) :: নব্বইয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, কবি, শিশুতোষ গল্পকার, সাংস্কৃতিক কর্মী ও কক্সবাজারের কৃতি সন্তান কবি মানিক বৈরাগী, শৈশব থেকেই পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। শৈশব থেকেই জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসর মাতামুহুরি খেলাঘর আসর দিয়ে সাহিত্য সৃংস্কৃতি পরিবেশে বড়ে উঠা পরিচয়। সেই শৈশব থেকেই গণ সঙ্গীত, আবৃত্তি শেখা আর খেলাঘর এর দেয়ালিকায় লেখা ছাপানোর উৎসাহ থেকে ছড়া’র সাথে সখ্যতা। ক্লাস সেভেনে প্রথম প্রিন্ট আকারে ছড়া প্রকাশিত হয়।

অধ্যাপক কবি রাহগীর মাহমুদ এর ছোট কাগজে সেখান থেকে ছড়া লেখা কৈশোরে নিজ উদ্যোগে ছড়া পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদক ‘পন্ড শ্রম”। তারুণ্যে এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও কাব্য আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই সময় প্রকাশ করেন ভাজ পত্রিকা ” মুক্তির উল্লাস”।

এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ছাত্র সংগঠন হত্যার উদ্যেশ্য হামলা করলে পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। কক্সবাজার কলেজে বিএ পাশ পরিক্ষা ও তিন টি দেয়া হয়নি। কারণ তখন ছাত্র সংসদ ছিল সেই মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনের দখলে। তাদের চাঁদা দিয়ে পরিক্ষা দিতে ইচ্ছে না করায় আর দি নাই। এরপর ধারাবাহিক ছাত্ররাজনীতি ও দলিয় রাজনীতি। বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন।

জেলা ছাত্রলীগের ও গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন। বিগত চার দলিয় জোট সরকারের সময়ে বহু মামলার ফেরারি জীবন, পুলিশের হাতে গ্রেফতার, রিমান্ড, ও জেল খাটা।পুলিশি রিমান্ডের কারণে আজ শারিরীক সক্ষমতা রহিত অবস্থায় আছি। জেল ও ফেরারি জীবনের কারণে জন্মদাতা পিতা মাতার নামাজে জানাজা ও পড়তে দেয়া হয়নি। জোট সরকারের সময়ে ছাত্রদল যুবদলের ক্যাডাররা আমার থাকার ঘর হামলা করে ভেঙ্গে দেয়।

পুড়িয়ে কয়েক লক্ষ টাকার নিজ সংগ্রামের বই , জেল থেকে বের হয়ে দেখি আমার জন্য রাজনীতিতে শূণ্য স্থান কোথাও নেই। তারপর আবার ও ফিরে আসা লেখালেখির জগতে প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ চারটি- গহিনে দ্রোহ নীল, শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্থ করেছি, নৈনিতালের দিন, শের এ মানিক বৈরাগী। শিশুতোষ গল্প গ্রন্থ দুটি- বন বিহঙ্গের কথা, ইরাবতী ও কালাদান। বিবাহ বিরোধী অবস্থান ও ঘোষণা থেকেও ভাই বোন মিলে হটাৎ এসে জোরপূর্বক কক্সবাজারের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আটকে রেখে বিয়েতে সম্মতি আদায় করা কবি মানিক বৈরাগী’র ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবি ও সাহিত্যিকদের লেখায় বিশেষ ক্রোড়পত্র পাঠকের কাছে তোলে ধরা হলো।

কবি সম্পাদক অমিত চৌধুরীর লেখায় মানিক বৈরাগী

————————————

ছাইস্বর্ণ অম্লজলে : যুগযন্ত্রণার দর্পন

কাব্যের বাঙময়তায়  যখন স্বদেশপ্রেম ধরা পড়ে তখন মনে হয় মাকড়সার জালে আটকা পড়েছে পদ্মা-মেঘনা- যমুনার ঠিকানা । কেননা  সমকাল পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে বর্ষীয়ান পণ্ডিত প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন , রাজনীতির মর্মে দেশপ্রেমের অভাব’ জাতীয় একটি উক্তি। এ মন্তব্য যদি ১০% ভাগও সত্যি হয় তাতেই হতে পারে দেশের সর্বনাশ। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রয়াত ভারতীয় চিত্রকর মকবুল ফিদা হোসেনের ভাষায়, ‘যারা রাজ করে তারা একেকটা ভাড়’। এ মন্তব্য নিতান্ত উপেক্ষার ছলে ছুঁড়ে ফেলা যাবে না। সেখান থেকে যদি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা বেছে নিতে হয় তবে বিশ্বাসভাজন মহান নেতার আড়ালে-অতলে বা করতলে লুকানো থাকতে পারে। কাব্যের পরিচিত পরিধির বৃত্তে ঘুরে আসতে হলে যে কোনো রহস্য লুকানো তা মূলত ছাই ভষ্মের ভেতরে লুকানো স্বর্ণকণা খুঁজে পেলেই স্বর্ণোজ্জ্বল পদার্থ কুড়িয়ে আত্মতৃপ্তিতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুর তোলা শব্দশিল্পী তথা কবিকে আগায় এবং তিনি শব্দের মালা গাঁথা-কাব্যের নির্মাণকলায় তার অন্তস্থলে লুকানো স্বদেশপ্রেম কিংবা প্রেমের রহস্যজালে আটকা পড়া বাস্তবতায় উপমার উপসংহার টেনে দিতে যা করতে হয় তাই কাব্যের ভুবনে কবিরা করে থাকেন। কবি মানিক বৈরাগী তার কবিতায় স্পষ্টত তাই করেছেন-আর প্রকাশকের পক্ষ থেকে মানিকের কাব্যগাঁথা সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রণিধানযোগ্য বিধায় ফ্ল্যাপের প্রথম অংশে উদ্ধৃতি টেনেই দিতে ইচ্ছে-
‘বৈশ্বিক অবক্ষয় দুর্যোগ মহামারির মহা ক্রান্তিলগ্নে অদম্য অভিলাষী মানুষ যখন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ডানা মেলার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখন মানিকের কবিতা হয়ে ওঠে মানবিক বোধিসত্তার অমিয় প্রস্রবণ।’

এ উদ্ধৃতি অস্বীকার করার মতো পথ খোলা নেই। কেননা সারাবিশ্বের তাবৎ কবিরা সখা কাব্য করে তথা মনে রাখতে হবে তার প্রেমিকের মতো কিংবা কোনো প্রেমিকার মতো একে অপরকে সম্পর্কের প্রেমের খেলায় ভালোবাসার ফুটন্ত-চামেলী হয়ে যায়। অন্যদিকে বিশ্বের দুঃখ- দৈন্য করোনার যন্ত্রণায় বিশ্বের তাবৎ অস্থিরতা মানিকের কবিতায় প্রাণ পেয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা তার কবিতায় স্বদেশের সীমানা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতাকে স্পর্শ করেছে। কেননা আমরা তার কাব্যের বাক্ময়তা প্রথমেই লক্ষ্য করি- ৮০ পৃষ্টার এ কাব্যে ৬টি পর্ব রয়েছে। প্রথম পর্বে নামই একিট কাব্যের নামকরণ হলে আরও ভালো হতো। কেননা ‘চাঁদমারি বনে জোসনার প্লাবনে’ অংশে। আবার ৪টি নাম পাঠের কবিতা। এখানে কবিতা যে  রহস্যময় এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ প্রেমই তো বড় রহস্যময় আর এ রহস্যময়তা ছাড়া কী কাব্য হয়? উত্তর হোক না। তার প্রথম কবিতায় উদাহরণে এ বিষয়ে লবণ জলের জলতরঙ্গে ঢেউ খেলে যায়-

‘ভাটফুল হাতে মারমেইড আসে ক্ষত- বেদনের জমিনে
হৃদ- যৌবনে,
জশ উঠে থির থির কাঁপে অপার আনন্দের স্বর্গসুখে (বেদন ভ্রূণ, পৃ. ১১)

২.
ও হেমন্তের তারাভরা আকাশ
ইলশে মেঘের গুচ্ছ গুচ্ছ তারা
কেন আসো উঁকি দাও বাতায়নে
রেশমি কোমল বাতাস ঝিরঝির বাও।
হৈমন্তি জোসানার যৈবতী তারার মেলা দেখবো বলে
অসাড় বিছানায় কাতরাই ব্যথা- বেদনার যন্ত্রণায়। (হৈমন্তী জোসনা দেখবো, পৃ. ১২)

৩.
ও চাঁদ, তুই কি জিনিস আমার কলঙ্ক
চোখে চোখ ঠোঁটে ঠোঁট রেখে মুখোমুখি
সত্য ও ন্যায়ের তরে তর্জনী উঁচিয়ে বলি তুই রাজাকার! (বেলাজ জোসনা, পৃ.১৩)
কিংবা একই কবিতায় তার বলিষ্ট উচ্চারণ-
‘নবি ও রাসুলে বিশ্বাসী সুফির জলসায় গীত গাই সর্বেশ্বরের
একাত্তরের প্রাণপণ যুদ্ধে ভাই লড়েছে হানাদারের বিরুদ্ধে,
এমনি জোসনা পহর রাইতে চাঁদের আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ঘর
মুজিবের নামে মুক্তিযুদ্ধ, লেনিন মার্কসের জ্ঞানে সমাজতন্ত্র
স্বপ্নদেখা মানুষেরা জোসনার রূপ যৌবনে বিভক্ত বিভ্রান্ত (বেলাজ জোসনা, পৃ. ১৩)
অথবা
‘কলঙ্কের দায় নিয়ে সীতার  পাশে মরমে মরমে পুড়ে রাবণ। (বেলাজ জোসনা, পৃ. ১৩)।
আবার একই পর্বের শেষ  তার বলিষ্ট দৃষ্টি সম্পাত-
‘কামনাকাতর লীলা-লাস্যে অস্থিও শয্যায় চন্দ্রাবতী
চন্দ্রাবতীর তির্যকযোনি রসের তীব্রতাই চন্দ্রজ্যোতি। (বেদন ফুল, পৃ. ১৫)

উপমার সময়ের দেহভাগ যদি হয় বাস্তবতা, উপমার সাথে উপমেয় হয় আরও অধিকতর গুরুত্ববাহী। কেননা এখানেও রহম্যময়তায় মায়াবী মেঘের আড়ালে দেখবো তারার মালা। লুকোচুরি জোসনার রুমাল উড়ে যাওয়ার দৃশ্য কবির দৃষ্টি এড়ায় কী করে? অতঃপর তার কবিতায় বৈশ্বিক যন্ত্রণা, সাম্রাজ্যবাদীর লোলুপ থাবা বিস্তারের দিকও কবিতার দাস যে জলদাসের চেয়ে হার না মানা টানে টেনে নেয়- ভিয়েতনাম, নিকারগুয়া, বসনিয়া, এঙ্গোলীসহ সাম্রাজ্যবাদী থাবার করাল গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি আফ্রিকার অনেক দেশ। উদ্দেশ্য মানুষ মারা নয় তাদের সম্পদ লুট করাই তাদের প্রকৃত চিন্তাচেতনা। তাদের লোলুপতা দেখে আমাদের দেশে ইকাডুয়ের বিপ্লব যে বেহাৎ হয়েছিল তা সলিমুল্লাহ খানের লেখার মতো করে মানিকের লেখাও কাব্যিক প্রকাশ বাড়তি অর্জন। তার উচ্চারণ-
‘জন্মেছি এ বঙ্গভূমে, শ্রেণিসংগ্রামের বিপ্লবকালে বেহাহ হতে সময় লাগেনি
স্বদেশের বিপ্লবী জনস্বপ্ন
..
গোলাকায়নের বেগুনি জালে প্রতিযুদ্ধও আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, চতুর সাম্রাজ্যবাদ (সাম্রাজ্যবাদ, পৃ. ২৩)।
২.
ফেনাফুলের নিষিক্ত মধুরেণু চুষে ওড়াউড়ি করে
বিষাক্ত জনন- প্রজননের জাল বিস্তার করে বিশ্বায়নের।
তবুও
মিছিল হয় মিছিল আসে, শান্তি আসে না। (শান্তি আসে না, পৃ. ২৪)
৩.
আদর্শ অলিক বাস্তবতা
নীতি-নৈতিকতা সুদূর পরাহত
সুগন্ধি আতরমাখা কালো কোট
জরির নকশা আঁকা কাশ্মীরি শালে
অনুদানের ট্রেডমার্ক জ্বলজ্বল করে
নেতার আশকারায় পা নাচায় মঞ্চে বিজিত শকুন
দূর সব শালারা মান্দারচুত, সাম্রাজ্যবাদের দালাল ! (কুফল, পৃ. ২৬-২৭)।

দ্বিতীয় পর্বের ‘কবি ও জনতা’ কবিতায় কবি তুলে এনেছেন রাজনীতির নামে ফটকাবাজি, ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি, গালগল্প  করা, পাড়ায় পাড়ায় আল্লাহ রাসুল সুন্নী-ওয়াবী-মওদুদী ওয়াজ ব্যবসায়ীদের আস্ফালন, ঐতিহ্যবাহী লালদিঘির বেওয়ারিশ গুল্ম, দখল-বেদখলে তছনছ লালদিঘি আর লালদিঘির আগের জৌলুস ফিরিয়ে দিতে মেয়রকে কবিকে ফেরত দেয়ার কথা, নষ্টভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের দেহজীবীনির টাকাও মেরে খাওয়ার চিত্র। এ কবিতায় শিশুরা যখন কবিকে ফেরত দিতে দাবী জানায় তখন মেয়রের পেছন হাঁটা কমিশন খাওয়া কমিশনার বলে উঠেন, ‘কবি তোমাদের কি দেয়, আমিই তোমাদের পাশে থাকি বলে ঢেকুর তোলে।’
কবি কখনো দেখেনি উদ্ভিদ উদ্ভিদের ক্ষতি করতে, দেখেনি উড়ন্ত শকুনকে মানুষ খুন করতে। শুধু দেখে মানুষ মানুষের রক্ত নিয়ে খেলা করছে। আর তাই কবি মানুষের মাঝে রক্তপাত দেখে ক্ষান্ত থাকতে পারেন না। তাই কবি মানিক যিশুর বুক কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ করেন-

‘আমি যুদ্ধবিধ্বস্ত বিংশ শতকে মানুষরূপে জন্মাতে চাইনি
পিতা মাতার অন্তিম বিনোদনের সর্বকনিষ্ট হাবিল-কাবিলের জাত
প্রভুর কাছে প্রার্থনায় বলেছি, অন্তত অর্জুন গাছ করে যেনো পাঠায়
মহাপ্রভু আমার কথা রাখেনি, আমাকে করলো হাবিল-কাবিলের উত্তরাধিকার। ( যিশুর বুক, পৃ. ৩৩)

আমরা স্পষ্টত জানি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও বিশেষ করে উত্তর দক্ষিণ গোলার্ধে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাস মানুষকে হত্যাযজ্ঞে বা গ্যাস চেম্বারে, কিভাবে বিধ্বস্ত করে হত্যা করেছে হিটলার। কবি তাই জন্মাতে চাইনি বিশ শতকে।
আর তৃতীয় পর্বের একটি কবিতায় যখন প্রেমই মুখ্য-সত্য প্রকাশ পায় তখন কী করে না লিখে পারে-
‘ চলে এসো রাই বিনোদিনী হয়ে, জমে উঠুক বৃন্দাবন
বেজে উঠুক শ্যামের বাঁশি।’ ( অভিমান, পৃ. ৪৩)।
আজ আবার হতাশাও প্রেম, হতাশার ভেতরেও সৃষ্টির বেদনা, সে বেদনার নাম নূরের জাহান, নুরের জয়নাব। কবির কাব্যের লক্ষ্মী যেনো কবির পিতার মা-জননী। কী আশ্চর্য একলা জীবন , প্রাণের সখী প্রয়াত কবি মাসউদ শাফির সাথে ঝড়-বৃষ্টি-শৈত্য প্রবাহ যাই আসুক না কেন-সমুদ্র পাড়ের হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে এক সাথে রাত কাটানোর নেশাগ্রস্ত নিয়তির স্মৃতিও কী ভোলা যায়? বন্ধুত্বেও স্মৃতিচারণের গাঁথায় তো কবিতায় হয়ে উঠে প্রীতিকায়ন বা প্রেম গাঁথার রূপেই। বি নুরকে শুধায়-
‘নূর, তুমি বুঝবা না রাতের সমদ্র কি অপরূপ! সফেদ ফেনিল হেঁটে আসে
মারমেইড
ততক্ষণে হয় সৈকতের কিটকটে
ইা হয় জোয়ার ভাটার ওয়াচ টাওয়ারের টঙে ঘুমঘোরে
রুদ্র কিরণে প্রভাত দেখি, পাতাকুড়োনির দল, বেশ্যাদের টাকা-পয়সার
ভাগ-বাঁটোয়ারার শোরগোলে ঘুম ভাঙে ( ঘুম নগর, পৃ. ৪৭)
আবার কখনো প্রেম ও প্রকৃতি  এক হয়েছে বর্ষাতি কবিতায়। তার শেষ উচ্চারণ যেনো ছোট গোলকের ছায়ায় পড়ে আছে গ্রীষ্মের রাণী, মেঘের বৃষ্টিভেজা আঙিনায়-
‘শ্রাবণী হালকা করে কাচটি মুছে দাও, তাকাও দক্ষিণে
দ্যাখো বৃষ্টি পেলবতায় কেমন সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষদেব। (বর্ষাতি, পৃ. ৫৫)
অথবা অকাল প্রয়াত কাব্যের বরপুত্র হাসানের জন্য শোকগাথায়-
‘হাসানের সূর্যোদয় খুব মনে পড়ে, সুরাইয়া কেমন আছে? (আমি তুমি সে, পৃ. ৫৬)।
কবির কাব্যগাঁথায় প্রেম, স্বদেশ প্রেম, বিশ্বায়নের বিস্তীর্ণ বসতি গড়ে উঠা অভিবাসীদেও বসত ভিটের ভেতের শরীরে সুখের প্লাবন ও অসুখ বিসুখ বিস্তির্ণ ফণা তুলে আছে অজগরের গো-গ্রাসে। কেননা শতবর্ষ পরে সময়ের ঘোরেঘোরে কত অসুখ বিসুখ ক্ষয়ে গেছে তা ইতিহাস মাত্র। কেননা করোনা কিংবা ওমিক্রনের অসুস্থতায় করালগ্রাসে দেখে কবিকেও ভাবতে হচ্ছে সমস্যার বেড়াজাল নিয়ে। এসব বিষয় আশয় নিয়ে তাই কবির উচ্চারণ-
‘প্রকৃতির অমোঘ খেয়ালে মানুষের পীড়নে ভোগের বুদ্ধির বিকাশে
হাজার বছর কত গবেষণা, কত লড়াই যুদ্ধ নিজের বিরুদ্ধে নিজে
নিজেদের ভোগ ক্ষমতা সাম্রাজ্য বিস্তারে মানুষ মানুষের হত্যাকারী
বাদ রাখেনি মাটির গভীরতা
সমুদ্রের তলদেশ
প্রাণী-উদ্ভিদ-জল- তেল-গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহ
এইসব মারণ উৎসবে আমকেই করলো উজাড়
অথচ ধরিত্রীর এই অবদানের বিনিময়ে চায়নি কিছুই মানুষের কাছে।
একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মানুষের মরণখেলায় মেতেছে জীবাণু অস্ত্রে
আবারও মানুষ মানুষকেই করছ গুহাবাসী গৃহবন্দি
আজ আমি প্রাণভরে নিজেকেই মেলে ধরলাম
দ্যাখো আমাকে
নিজেও থাকো বিশ্রামে
ব্যস্ত মেরিন ড্রাইভে আবারও সবুজের হাতছানি
যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন
পিকনিক যুবাদের লাউড স্পিকারের কানফাটা চিৎকার নেই

আহা ধরিত্রী!
তুমি আমাদের সৃষ্টিসুখ। ( ধরিত্রী, পৃ, ৭৪-৭৫)।
প্রকৃতির কবি এ কাব্যে গাথায় প্রেমের প্রকৃতি, স্বদেশে, স্ববিশ্বের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বায়নের দিকে মানব জীবনের সাথে সঙ্গতি ও অসঙ্গতি পূর্ণ-সর্বসত্য গাঁথাতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়েছে যে, সৃষ্টির অপার রহস্যের দ্বার উদঘাটন কিন্তু মানুষ্য জীবনে কবিতাই দূরে দৃষ্টি দিতে কল্পনার কল্প রাজ্যকে বাস্তবে টেনে এনে স্বর্ণকার যে ছাই ভষ্মের ভেতরে স্বর্ণকণা খুঁজে নেয় তেমনি মানব জীবনের ছোট ছোট ব্যথা, ব্যথিত জীবনের প্রেমের খেলা, স্বদেশ প্রেমে যুদ্ধ করে স্বদেশের স্বকীয়তা আনয়ন কিংবা জড়গ্রস্ত অসুখ ধরিত্রীর বিষয়ে জলে ভেলা প্লাবনের ডেক তুলে সাগরমতা পেয়াস্তা ছাইয়ের অম্লজলের ভেতর থেকে সর্বমানুষের যুগযন্ত্রণাকে তুলে আনতে পেরেছে কবি মানিক বৈরাগী। প্রকৃত অর্থে  মানিক বৈরাগী কবিতায় বস্তুর অন্তর্নীহিত সত্যের রূপকার। তাই তাকে অনুসন্ধান করতে হয় ছাইরূপি মহাবিশ্বের ভেতর খাঁটি স্বর্ণ সত্য।

No photo description available.

শের-এ মানিক বৈরাগী ঃ আত্মদর্পনের চিত্র।
————————————————–
‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ কবি মানিক বৈরাগীর ৬ষ্ঠতম গ্রন্থ এবং কাব্যগ্রন্থের মধ্যে চতুর্থ। এ ছাড়া সম্প্রতি আগামী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৫ম কাব্যগ্রন্থ ‘ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’। আমরা জানি স্বরবৃত্ত ছন্দ ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কাব্যিক নান্দিকতা প্রকাশে উদার জমিন। তবে কাব্যগাঁথায় যদি ছন্দের মিলে অনুপ্রাসের অনুরণনে গীত কবিতার মতো অনুরণিত হয় এবং স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের স্বরের বিন্যাসে ত্রুটিহীন ছন্দ মাধুর্য ফুটে উঠে তখন তা স্বার্থকতার পর্যায় পেরিয়ে হয় প্রাণবন্ত।

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের গীত কবিতা এবং সতেরো ও আঠারো শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে যে সকল কবি কাব্যচর্চা করে গেছেন তৎমধ্যে হাফিজ, রুমি ও মির্জা গালিব, বার্মায় নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর অন্যতম। এতদসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে অখণ্ড বঙ্গদেশসহ আরাকান রাজ্যে যে সকল কবিরা (আলাওল, দৌলত কাজী, কোরেশি মাগন ঠাকুর, আবদুল হাকিম, নসরুল্লাহ খোন্দকার, কাজী শেখ মনসুর প্রমূখ) কাব্যচর্চা করেছেন তারা মূলত আরবি ফারসি ও আরবি ফারসির মিলনে দোভাষী পুঁথির রচনা করেই গেছেন। আজকের আলোচ্য কবি মানিক বৈরাগীর কাব্যগ্রন্থ ‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ অন্যান্য আধুনিক কবিতার মতো  এক নয়। তার এ কাব্যগাঁথায় ‘কলবে অমর্ত্য সুবাস’, জীবনবৃক্ষের রং, চৈতন্যে সুখ শরাব’ নামক তিনটি পর্বে মানবজীবনের সম্পর্ক, চরিত্র, দারিদ্র, আধ্যাত্মিকতা এবং আত্মজ দর্পণের চরিত্র চিত্রণ করেছেন।

‘কলবে অমর্ত্য সুবাস’ পর্বে কবির চেতনা আধ্যাত্মিকতার উচ্চ মার্গে উচ্চারিত হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। মানুষের জীবন সত্য জন্ম ও মৃত্যুতে। এই অমোঘ সত্য ধারণাটি তার প্রথম উচ্চারণে বাকময়তা পেয়েছে। ‘যদি ডাক আসে যেতে হবে/ মোহময় মর্ত্য ছেড়ে অমর্ত্যলোকে।’ (পৃ.১১) এ বিশ্ব তথা ধরিত্রী মাতার উপর পরম সৃষ্টিকর্তা তথা কোনো এক রাজন্যবর্গ যেনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকেও ছাড়িয়ে গিয়ে আমাদের মতো নরাধমের বসতি দুনিয়া শাসন করে যাচ্ছে। এ যাওয়াকে কবি মানিক বৈরাগী স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন, ‘অমর্ত্যলোকে বসে আছেন এক রাজাধিরাজ/ হুকুম তামিলে প্রস্তুত সেপাই সেনা বরকন্দাজ।” অথবা “কলবে যদি খোদা না থাকে তবে/ লোক দেখানো নামাজে কী হবে!” (পৃ.১২) এখানেই কবি মানিক বৈরাগীর আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার পরিচায়ক। আমরা সাধারণত লোক দেখানো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এমনকি খোদার সাথে পর্যন্ত প্রতারণা করি। ভেকধারী পোশাকে আমরা খোদা ও রাসুল বলে বলে চিল্লায় কিন্তু অন্তুরে এবং খোদার নামে ভন্ডামী করি। কবি মানিক বৈরাগী এসব সামাজিক চিত্র তুলে ধরেছেন ‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ কাব্যে। এ কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশ দুই লাইনের হলেও অনেক বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি চিত্রিত করেছেন ধর্মান্ধ ভণ্ডবাদী এবং ধর্মের নামে মিম্বরে উঠে খোতবায় অন্য ধর্মের কবর রচনা করে। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, অন্য ধর্মের কবর রচনা কিংবা সমালোচনা করার জন্য রাসুল (সঃ) মিম্বরের ধারণা পোষণ করেননি। কবির ভাষায়, “ওহে ইমাম খুতবায় খুঁড়ো অন্য ধর্মের কবর/ জুমার হজ নষ্টের জন্য নবিজি করেননি মিম্বর।” (পৃ-১৫) এই পর্বে খোদার আসনে বসা সৃষ্টিকর্তার কাছে কবির আরাধনা এ রকম, ‘পরস্পরের তলোয়ার আর বোমার আঘাতে/ মানুষই যদি না থাকে দুনিয়ায়/ খোদার গুণকীর্তন জিকির-আজগর কেরামতি/ কে চেনাবে হায়! (পৃ – ১৯)

তার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘জীবনবৃক্ষের রং’। এখানে উল্লেখ্য যে, জীবনবৃক্ষের উদার নৈতিকতা। অবুঝ বৃক্ষের মতো জীবনবৃক্ষ যদি উদার না হলে কী স্যার জগদীশ বসু কিংবা কবি জীবনের সবুজ সমারোহ নিয়ে…. কী কবিতায় বাক-প্রতিমায় উচ্চারণ করতে পারেন ! আসলেই জীবনবৃক্ষ ও সবুজের সমারোহের মতো জীবনের বাঁচার জন্য দরকার অক্সিজেনসমূহের মহিমায় তৈরির জন্য প্রয়োজন উদার নৈতিক মেটাফিজিক্যাল ফিলসপি বা দর্শনগত ভাবনার বাগ্ময়তা। এটা অবশ্যই শুদ্ধতম কলবের উৎসারণ হবে। তবে এ পর্বের গাঁথাগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রবাদ বচনের মতো। যেমন- “রক্তের বাঁধন যায় না অস্বীকার/ চুন থেকে পান খসলেই পাবে তিরস্কার।” (পৃ-২৮) “বংশগত দরিদ্র লোক যদি হয় ধনী/ অহংকারে প্রতিবেশী পিষ্ট হয় জানি।” (পৃ.২৯) “পিতা অর্বাচীন পুত্র শিক্ষিত হলে/ শ্বশুর-শাশুড়িকে চাকর বলে।”(পৃ-৩০) উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দ্বিতীয় কন্যা মাধুরী লতার শ্বশুরবাড়ি কবি বিহারী লাল চক্রবর্তীর ব্যারিস্টার সন্তান শরৎ চক্রবর্তীর (যাকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আমেরিকাতে ব্যারিস্টারি পড়ার খরচ যুগিয়েছিলেন) বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন। কারণ মেয়ে মাধুরী লতা ক্যান্সার জাতীয় রোগে অসুস্থ ছিলেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের বাসায় সকালে যেতেন আর সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতেন। এভাবে যাওয়া আসার ফাঁকে তাদের বাসায় জামাই শরৎ চক্রবর্তী শ্বাশুরের সামনে টেবিলের উপর পা উঠিয়ে বসে থাকতেন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র কিংবা ব্যারিস্টার জামাই অর্বাচীনভাবে শ্বশুরের সাথে অসৎ আচরণ করেছে। এ জাতীয় ঘটিত বাস্তব ঘটনাকে মানিক তোলে ধরেছেন তার আধুনিক প্রবচনে।  আধ্যাত্মিক চেতনাকে ধারণ করে জীবনের বৈচিত্র্যময় রং ছড়ানো যায় বটে, কিন্তু এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার মাঝে প্রমোদ বালককে নিয়ে লেখাটি আমাদের ভাবায় । “প্রমোদ বালকের নিতম্বে মেদের লাবণ্য/ বিকিয়ে জনে জনে সে হয় ধন্য।” (পৃ-৩৪) মানিকের এ প্রবচনটিকে সম্পূর্ণ প্রতীকি বলে মনে হয়। সমাজে অনেক গুরুত্বহীন ব্যক্তি আছে, যারা নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে আপনাকে জাহির করে। মানিকের এ বচনটি যেনো তারই আদিরসাত্মক রূপ। ঐসব ব্যক্তিদের হীনমন্য রূপটিকে হাফিজ, রুমি, গালিব, বাহাদুর শাহ কিংবা হাজার বছরের চৈতন্যকে ধারণ করে  আরো একধাপ ধরিয়ে দিয়েছেন মানিক। প্রমোদ বালকরূপী ছদ্মবেশীদের সাহিত্যের বাজারে চিহ্নিত করা মোটেও দুষ্কর নয়। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এ রকম ব্যতিক্রমধর্মী গাঁথা হলো “শৈর-এ মানিক বৈরাগী।

তৃতীয় পর্ব ‘চৈতন্যে সুখ শরাব’। এ পর্বে কবি প্রেম, গজল লিখিয়েদের ঐতিহ্য অনুসরণ, ব্যক্তিগত দূরাবস্থায় পতিত হলে আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের অট্টহাসি উপহাস, চলমান অপরাজনীতি, ধর্মান্ধ এবং স্বৈরাচার মনোভাব বিষয়ে আলোকপাত পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। মানিক বলেন-“নিজেই নিজের কাছে বিরক্তিকর উপদ্রুব/ কেন পেতে চাও এই ছোঁয়াচে সংশ্রব !” (পৃ-৪৫) “অযুত বেদনার বরপুত্র আমি, নাম মানিক বৈরাগী/আড়ালে সাইফুদ্দিন আহমদে মানিক-সুখের শরাবি।”(৪৬) এক কথায় মানিকের চিন্তা চেতনার ফল্গুধারা হাফিজ রুমি, বাহাদুর শাহ কিংবা গালিবের জমানার বাস্তুভূমি থেকে উৎসারিত হলেও আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে মানিক নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র।। এখানেই মানিকের বিশিষ্টতা একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার দৃষ্টিতে মানিকের দু চরণের গাঁথাগুলো যদি ছন্দের অনুপ্রাসে অনুরণন সৃষ্টি করে আরেকটু উন্নত পর্যায়ে উন্নীত হতো তাহলে দেশ পত্রিকায় ( মার্চ ২০২১ সংখ্যা) কবি শ্রীজাত গালিবের গজলের স্পন্দন ও ব্যাকরণ নামাঙ্কিত লেখার এক পর্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, কোন শিল্পই কেবলমাত্র আঙ্গিক বা ব্যাকরণ নির্ভর নয়, তার বোধ তার ব্যাপ্তি, তার দর্শন তাকে টিকিয়ে রাখে যুগের পর যুগ , যেমন আছে গালিবের গজল। তেমনটিই  পাওয়া যাবে মানিকের ‘শের-এ-মানিক বৈরাগী’ গ্রন্থে।

May be an image of cake

মৃত্যুর জয়গান নয় জীবনগাঁথা :
—————————————————
কবিতার জন্ম নাকি বিরহ বেদনায়। শেক্সপীয়র বলেন ‘ভালোবাসাময়’। ভালোবাসার সার্থকতা জানি-বিরহে দু’জন এক জায়গায় না থেকে দূরে থাকার মাধুর্যে। বলা যায়-মধুর যন্ত্রণাময়। কবি মানিক বৈরাগীর কাব্যগ্রন্থ ‘মৃত্যুর গান গাই’একুশের বইমেলা ২০২২ চট্টগ্রামের খড়িমাটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা জানি যে, মদের নেশায় মাতাল না হয়ে উন্মাতাল শব্দতরঙ্গে আমেরিকার প্রখ্যাত কবি গ্রীন্সবার্গ একটি কাব্য লিখেছিলেন একরাতে। আর তাই বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্র প্রতিভার প্রতিদ্বন্দ্বীতুল্য কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘ভালবেসে হয়ে উঠি একা’। এসব কাব্যগাঁথাময় মানুষ মানবজীবনের জয়গাঁথাকে ‘বিরহে ও মিলনের’অম্লমধুর মাধুর্যে অনুভব করে থাকে। তার এ কাব্যের আগের বইটির নাম‘ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’। এ গ্রন্থে তার বাঙ্গময়তার বাঁধনে নতুনত্ব ও উত্তরাধুনিকতার প্রয়োগ পৌরাণিক মিথের প্রয়োগেও অসাধারণ। মৃত্যু চেতনার যন্ত্রণাময় কবি যেনো Surrealism প্রভাবে ফরাসী কাব্যের গন্ধ শুঁকে নিচ্ছে নিজে ও বাঙালি কবিকুলকে দিয়েও। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। অর্থাৎ কবি যেনো কাব্যের বই লেখার মাধ্যমে স্থির চিত্তে মানুষ হিসেবে আত্মত্যাগ করেছেন। দ্বিতীয় মৃত্যুর মানে কবির মৃত্যু হওয়ার মানে দ্বিতীয় মৃত্যু। মানুষ হিসেবে সাধারণ মৃত্যু হচ্ছে এটা। কবির ভাষ্যে আর তৃতীয় মৃত্যু হচ্ছে ‘আমিও চলে চলি-তৃতীয় মৃত্যুর দেশে’। সেটি কোনটি? প্রশ্নোত্তর সোজা। কবির জন্মভূমি মাতামুহুরীর ভাটির টানে। তাই কবি ভেসে চলেন মাতামুহুরীর টানে টানে। পুরোরাজ্য ঘুরে আসলেও কবি মানিক বৈরাগী নাড়ির টানে মাতামুহুরীর তীরে ফিরে আসে।
কবির ভাষায়-
নগর নীরব, নীল জোছনায় ডাকাত শীতের কামড়
সাদা কুয়াশায় ভিজে সুবেহ সাদিকের কর্পূর সুরভি মেখে
মাতামুহুরির ভাটির টানে, আমিও ভেসে চলি তৃতীয় মৃত্যুর দেশে।
কখনো কাঁদেনি বৃক্ষপাতা ঝরে গেলে
তবুও পলি জমে তলানিতে, চর জাগে বাস্তুহীনেরা স্বপ্ন দেখে
প্রতিদিনের ঝরাপাতা পলির স্তুপ জমে মনের অতলে
হৃদয় চরে ফুটেছে নীল ক্যাকটাস, স্বপ্ন দেখেনি কেহ
আমি শুধু স্বপ্ন দেখি চতুর্থ মৃত্যুর দেশ। ( মৃত্যুর গান গাই, ১, পৃ. ৭)।

সার্বিক বিবেচনায় গাছের ডাল কাটানো বৃক্ষও কাঁদে। কিন্তু তা ঝরে গেলে কাঁদে না বলে মনে হয়। আবার কবির চৈতন্যে নদীর বুকে উর্বর পলি যে এক সময় খালি হয়ে যাবে। রস ও নীল ক্যাক্টাস হলে স্বপ্ন দেখেনি এখনো। কেননা আকাশ মানে তো অসীমলোকের শূন্যতা। যার বিস্তীর্ণ সৌরলোক এজন্য বিশাল জলদীর মতো নীলাভ। স্বপ্নীল চোখ না হলে কী এটার সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়? কবির স্বপ্ন দেখা তাই-চতুর্থ মৃত্যুও দেশ-খুঁজে ফেরা। কেননা কবিরা এরকম দেখতে পারে। আত্মত্যাগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ-জীবনানন্দ দাশ- ‘আট বছর আগের একদিন’। এ কবিতায় মৃত্যৃ চেতনার গানের স্বরে স্বপ্নভগ্ন হৃদয়ের আকুতি অবোধ মানুষের মত বোঝানোর জন্যই কাব্যমালার সৃষ্টি।
তৃতীয় অনুস্বরে অংশে যমদূত তথা আজরাইলকেই তো কাব্যিক গাথায় চমকে দিয়েছে কবি মানিক বৈরাগী। তার উচ্চারণ-
`আজরাইল সাহেব একটু দাঁড়ান
এখনো তার সঙ্গে আমার গল্প শেষ হয়নি।’

আজরাইলকে উপেক্ষার ছলে মানিকের উচ্চারণ-
`গোস্তাকি মাফ করবেন আমার
অন্যত্র তাড়া আছে
আচ্ছা যাও আমি ডাকবো (মৃত্যুর গান গাই, ৩, পৃ. ৯)

এখানে কবি যুদ্ধেও ভয়াবহতার বিরুদ্ধে এক কাতারে সামিল হওয়ার জন্য কাস্তে হাতুড়ির যুগল চাহিনি বাজিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ‘এসো মৃতুর গান গাই’ঘোষণার জয় ঢংকা বাজিয়ে। তার চেতনায় বিপ্লবী আবুজর গিফারীর কলবের নফসে সিল মেরে বলতে পারেন ‘ম্যায় কুচভি নেহি, নেহি ইমানদার’(মৃত্যুর গান গাই, পৃ ১০)। এখানেও এ সত্য ধ্রুবসত্যে উপনীত। কেননা সৎ ইমানদার মানুষের সংখ্যা যদি বেশি হয়ে থাকে-তাহলে বিশ্বটাই হয় স্বর্গ নগরী। আর কাউকে নরক যন্ত্রণায় ভোগ করতে হবেনা হয়তো। গড়পরতা মানুষের মতো কবি এখানেই তার উচ্চারণের চারণধ্বনি-
‘আমি মানুষপ্রাণী, এ কারণে প্রাণসত্তা আলাদা, সেটা টের পায়
পৃথিবী, খোদা। খোদাকে শুধাই, তোমার পরীক্ষার ফল
প্রকাশিত হবে কবে? ইলহাম আসে ইথারেও, বাতাসে বাতাসে,
পাতালে আর ঊর্ধ্বে আচানক শিহরণ জাগে তণুমনে, আমি টের
পাই, আরো পরীক্ষণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করবে আমাকে। (মৃত্যুর গান গাই, ৫, পৃ-১১)।

আর স্পষ্ট করতে চায় কবির রাজনৈতিক চেতনাকে। তিনি উপলব্ধি করেন ছাত্র আন্দোলন থেকে, চৌরাস্তার মোড়ে ভাষ্কর্য নির্মাণ, অথবা নিজের হাতেই নিজের মিনার, ‘কিতাবি আদর্শে কীট মানুষের প্রপঞ্চক বক্তব্যে শ্রেণিসংগ্রাম, ক্রুসেড, জিহাদে বেড়েছে সংঘাত দেখতে দেখতে ‘কতো প্রাণ হলো বলিদান’(পৃ: ১২)। মিছিল মিটিং থেকে শিক্ষা নেয় রুশবিপ্লব পরবর্তী যুক্তবঙ্গের মানুষ ’ভঙ্গ দেশের দুই অংশে তাও ১৯২০/২২ এর দিকে। কাব্য হয়, হয় গল্প ও উপন্যাস। তলস্তয় কিংবা বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমানের কল্যাণের ‘জননী’ লেখা হয়। জননী জন্মভূমির বুকে তখন দেখা যাবে-‘কবির মৃত্যু হবে নিস্তব্ধ রূপালি জোসনা খচিত রাতে’। কবির ভাষায়-
‘আমার মরণ হবে নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ রূপালি জোসনাখচিত রাতে
পচা পুতিগন্ধে মুখরিত বাতাসে।
মোগলদের অরক্ষিত পানশালার পাশে নাচঘরের সাজোয়া
কামরায়। ভেজা শ্যাওলার পিচ্ছিল কার্পেটে বুলবুলের ললিত
নৃত্য মুদ্রা মুদ্রণ করছি বিষাক্ত গিরগিটির ছোবল খেতে খেতে। (মৃত্যুর গান গাই-৮, পৃ. ১৪)।
এভাবেও মানুষ পরলোকের সাঁকো পেরোতো চায়। এ চাওয়া মায়াকভস্কির স্বচৈতন্যে স্পষ্ট আত্মত্যাগের পিস্তল ছোঁড়া ধ্বনির ব্যাঞ্জনা শুনায়। এভাবে কবি চায় পরজন্মেও বেদন হতে। কবি মানিকের উপলব্ধি-
‘হে খোদা, আমার কাজ
বৃক্ষ হত্যা নয়। যার কাছে পাঠাও বারবার, তো মানুষ নয়,
বৃক্ষ। বৃক্ষের প্রাণহরণের কৌশল কী? জানিনা কীভাবে
বৃক্ষের জান কবজ করতে হয়।’

‘আবার যাও, যেখানে পাও ঐ বান্দার জান কবজ করে আসো।
তোমার যা যা দায়িত্ব তাই করো।’(মৃত্যুর গান গাই-১০, পৃ. ১৬)।

হুকুম তামিলে এসে দেখে বৃক্ষটি আর নাই কবিতা চত্বরে,
ওখানে গান গায় কোকিল, বাঁশি বাজায় হলুদিয়া পা্খি। (পৃ. ১৬)

বৃক্ষটির জন্য কাঁদছে প্রাণ, কাঁদছে তাই মৃত্যুর গান গেয়ে গেয়ে মৃত্যুবরণ করতে রাজি কবি। এ মৃত্যু কবিকে দেয় অমরত্ব।

 

কবি মানিক বৈরাগীর ৫২তম জন্মদিনের প্রত্যাশা : কামরুল বাহার আরিফ

রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় এক স্বচ্ছ আপষহীন মানুষ। যিনি একইসাথে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। একজন প্রাজ্ঞ পাঠকও বটে! নানামুখি পাঠে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। পাঠের ভাণ্ডার ঈর্ষা করার মত। আমার পাঠ সে হিসেবে অতি সামান্য। আর আমি এমন ঋদ্ধ পাঠককে সব সময় ভয় পাই নিজের অজ্ঞতার জন্য। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি আমার অনুজ, কবি মানিক বৈরাগী। প্রচণ্ড ধারালো বক্তব্যে তিনি সদাসোচ্চার। তাঁর ৫১তম জন্মদিনে অশেষ শুভকামনা ও ভালোবাসা। আপোষহীন মানুষ হিসেবে যেমন তিনি অনেকের প্রিয় তেমনি ধারালো সত্য বক্তব্য বা সমালোচনার জন্য তিনি সমানভাবে বিরাগভাজন একজন। তাই তো তিনি বারবার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আজ পঙ্গুত্বের অসহনীয় জীবন নিয়ে বেঁচে আছেন। কেনো এই প্রতিহিংসা কবির জীবনে সে ইতিহাস বড় দীর্ঘ ও নির্মম। এই প্রতিহিংসা তাঁর আদর্শের বিরোধীদের দ্বারা যেমন, তেমনি আদর্শের ঘরেও কম নয়। চির প্রগতিশীল চিন্তাধারার এই সাহসী মানুষটি দেশের প্রান্তিক সমুদ্রেঘেরা শহর কক্সবাজারে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন পারিবারিক ধারায়। পারিবারিক রাজনীতি থেকে তিনি সত্য ও ত্যাগের মহিমায় নিজেকে গড়ে তোলেন। ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে। সে ধারাবাহিকতায় তিনি মুক্তির জন্য বিপ্লবকে বেছে নেন জীবনে। সেই বিপ্লবকে জানতে তিনি আশ্রয় নেন বঙ্গবন্ধু, লেনিন, সুভাষ, ফিডেল কাস্ট্র, মাও-সেতুং, নেলসন মাণ্ডেলাসহ বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবীদের পাঠ থেকে। একই সাথে মানবিক মানবের পাঠও নিয়েছেন এইসব মহামানবের থেকে। তিনি ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে পাঠ নিয়েছেন ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকে। তাই তিনি একজন প্রকৃত ধার্মিকও বটে। এখানেও তাঁর বিশ্বাস অটুট ও আলোময়। তিনি মনে-প্রাণে যৌক্তিক। ধর্মে ও আদর্শে। অন্ধত্ব দিয়ে আলোকে জানা যায় না। যে কোনো আদর্শ, তা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় হোক না কেনো তা হতে হবে মানবিক ও মানব কল্যাণের জন্য। এই যুক্তিতে তিনি তার পাঠকে সমৃদ্ধ করে নিজেকে শাণিত করেছেন। তাঁর এই যুক্তিবাদিতা ও আলোময় আদর্শ ধর্মান্ধরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি সামরিক লেবাসের স্বৈরশাসকেরা। তাই ছাত্রাবস্থাতেই চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা কালিন সময়ে মৌলবাদিদের দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছিল। মৌলবাদী জঙ্গী ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির তাঁকে তাঁর হাতও পায়ের রগ কেটে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রায় পঙ্গ হয়ে যান। তারপরও থেমে থাকেননি মানিক। মানিক যেনো তার আলো আরও ছড়িয়ে দিতে চাইলেন অন্ধকার তাড়াতে।

এবার স্বীকার হলেন ক্ষমতাসীদের রোষানলে। তাকে গ্রেফতারের নামে অত্যাচার করে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে দিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দিলো! বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজ দলের সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদদেরও বিরাগভাজন হন এই কবি। আর এইসব সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদদেরা এক সময় দলে সংখ্যাগরিষ্ট হওয়ায় তিনি রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন। দলের এই নিগ্রহও তাঁকে আদর্শ থেকে একচুলও সরাতে পারেনি। ব্যক্তিগত জীবনে চরম অস্বচ্ছল এই মানুষটার ত্যাগ কেউ মনে রাখেনি যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য জনক। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পরে যে কটি মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মানিক বৈরাগী অন্যতম। অথচ বঙ্গবন্ধুর দল ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থেকেও এমন আদর্শিক ও বিরোধী দলের দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতিত নেতা-কর্মিরা কেনো সরকারের দৃষ্টির বাইরে আজও সেটা ভাবতে কষ্ট হয়। সাগরপাড় কক্সবাজারের মানিক বৈরাগী আজ নির্মম বাস্তবতার নিত্য সঙ্গী। আমরা জানি বারবার নির্যাতনের ফলে তার শারীরীক যন্ত্রণার কথা। তিনি প্রায়শই বিছানাগত থাকেন। অথচ নিজের চিকিৎসা করার সামান্য সামর্থও তাঁর নেই। তিনি তাঁর দুরাবন্থা ও চিকিৎসার জন্য সরকারের দৃষ্টি আনতে কক্সবাজার শহীদ মিনারে অনশন করেছিলেন। এমনকি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা জানি তখন মানবিক মানবী, মাদার অব হিউমিনিটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কবি মানিক বৈরাগীকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে শান্তনা দেন ও তাঁর যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই সহায়তার প্রতিশ্রুতি কয়েকটি বছর পেরিয়ে গেলেও কাদের হস্তক্ষেপে থেমে আছে জানি না। মানিক বৈরাগীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটছে দিনদিন। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত আছেন তাঁরা বিষয়টি নজরে এনে কবি মানিক বৈরাগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে নির্যাতিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই সৈনিকের বেঁচে থাকার সংগ্রামে এগিয়ে আসবেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলাকে দেখতে চাই যেখানে কবি ও শিল্পীরা তাঁদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা পায়। কবি লেখকরা একটা দেশের মুখচ্ছবি। তাঁদের পেটে ভাত না থাকলে, তাঁরা বিনা চিকিৎসায় ভুগতে থাকলে আমরা সভ্য বলে দাবী করতে পারবো না।

বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কবি, শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা বলেছেন বারবার। তিনি এটা মনে প্রাণে ধারণও করতেন। তার প্রমাণ পাই ভারত থেকে আমাদের জাতীয় কবিকে দেশে নিয়ে এসে আমাদের জাতিকে গর্বিত করেছেন। এমন উদাহরণ তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বহু দেয়া যাবে। পাকিস্তান শাসনামলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জনসভায় তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ। সে যাত্রার বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেন, ‘তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্মন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মত গুণী লোকের চাকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল।’ শিল্পী লেখকদের নিয়ে এমন ভাবনা ছিল আমাদের জাতির পিতা। শিল্পের প্রতি তাঁর এই মনোভাব আমাদেরকে গর্বিত করে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর গ্রন্থসমূহে বারবার বলতে শুনি, ‘কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না।’ আমারা বিশ্বাস করি, কবি মানিক বৈরাগীর আজীবনের ত্যাগও বৃথা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, মানিক বৈরাগী একজন কথার শিল্পী, কবি, অসংখ্য গ্রন্থের সৃষ্টাা। এবং বাংলাকে ভালোবাসা পিতা মুজিবের সত্যিকারের আদর্শের একজন অসাম্প্রদায়িক ও সততার প্রতীক। সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ।
আবারও ৫১তম জন্মদিনে কবি মানিক বৈরাগীর সার্বিক মঙ্গল কামনা করে তাঁর চিকিৎসা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দেয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দ্রুত পূর্ণ হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। জয় হোক কবির কবিতা ও জয় হোক কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের।

একলব্যের আঙুল : ফুল ও কাঁটার বিরোধ………….আলম তৌহিদ

বাংলা কবিতার আধুনিক যুগে দ্বিপদ বিশিষ্ট কবিতাকে অণুকবিতা বা কবিতিকা যা বলা হোক না কেন মধ্যযুগে দ্বিপদী ছন্দোবদ্ধ কবিতাকে বলা হতো দোঁহা। মানিক বৈরাগী রচিত ‘একলব্যের আঙুল’ কাব্যটিকে বলা যায় দোঁহার আধুনিক রূপ। কাব্যে দু’টি পর্ব ভাগ আছে-‘ফুল পর্ব’ ও ‘কাঁটা পর্ব’। ‘ফুল পর্বে’ রয়েছে ১৯টি দোঁহা, আর ‘কাঁটা পর্বে’ আছে ২২টি দোঁহা।

ফুল ভালোবাসার প্রতীক। এই ভালোবাসা প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে গুরু-শিষ্যের মধ্যেও। কাব্যের নামকরণ একথা মনে পড়িয়ে দেয় যে, এই ভালোবাসা বা ভক্তি আর্যঋষি দ্রোণাচার্যের প্রতি অনার্য যুবক একলব্যের হৃদয় নিসৃত গুরুদক্ষিণা। দ্রোণাচার্য ও একলব্য দু’টিই পৌরাণিক চরিত্র। নিষাদ গোত্রীয় নিচুজাতের একলব্যকে কৌলিন আর্যঋষি দ্রোণাচার্য ধনুর্বিদ্যা শিখাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এতে কিন্তু একলব্য দমে যাননি। তিনি গভীর বনে গিয়ে দ্রোণাচার্যের প্রতিকৃতি স্থাপন করে এবং তাকেই গুরু মান্য করে ধনুর্বিদ্যায় নিজেকে দীক্ষিত করে তুলতে লাগলেন। এভাবে স্বীয় প্রচেষ্টা ও সাধনায় এবং গুরুর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় একলব্য নতুন নতুন ধনুর্বাণ আবিষ্কার করলেন। অচিরেই একলব্য শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদে পরিণত হন। একদিন বনে একলব্যের সাথে দ্রোণাচার্যের সাক্ষাৎ ঘটে। একলব্যের অস্ত্র চালানো প্রতিভার পরিচয় পেয়ে জানতে চান কে তার গুরু ! একলব্য জবাব দিলেন দ্রোণাচার্যই তার গুরু। তৎক্ষণাৎ দ্রোণাচার্য বললেন, তাহলে গুরুদক্ষিণা দাও। একলব্য সরল মনে প্রতিজ্ঞা করলেন-আপনি যা চাইবেন তাই দেব। দ্রোণাচার্য বললেন, তোমার ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুলটি গুরুদক্ষিণা হিসেবে দাও। একলব্য নিজ হাতে বৃদ্ধাঙুলি কেটে গুরুদক্ষিণা হিসেবে দান করলেন।

প্রেম-ভালোবাসা কিংবা গুরুর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠার জন্য একলব্যের যে ত্যাগ স্বীকার তারই রূপচিত্র আঁকলেন মানিক ‘কাঁটা পর্বে’। মূলত ‘একলব্যের আঙুল’ ফুল ও কাঁটার বিরোধ। দোঁহাগুলোর রয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ আবেদন। ভাব ও অভিজ্ঞতার সুমাঞ্জস্য বিন্যাসে মানিকের প্রয়াস বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দোঁহাগুলোর কোনো একটিতেও একলব্যের নাম উচ্চারণ না করে মানিক হয়ে ওঠলেন একলব্যের প্রতিনিধি বা নিজেই একলব্য স্বরূপ। ফুল ও কাঁটা অর্থাৎ প্রেম ও সংঘাত। মানবজীবনের এই মনোজৈবিক দিকটি মানিক তুলে ধরলেন ‘একলব্যের আঙুল’ প্রতীকে। যার মধ্যে রয়েছে এক অনার্য যুবকের প্রেম-বিরহ-অধ্যবসায়-গুরুভক্তি ও কৌলিন আর্য অহংবোধের বিরুদ্ধে অনার্য জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপকে প্রতিষ্ঠিত করার দ্রোহ।

ছাইস্বর্ণ অম্লজলে ভাসমান কবি মানিক বৈরাগী : নাসের ভূট্টো
————————————————————
কবি মানিক বৈরাগীর কাব্য মানসের বৈশিষ্ট অন্যত্র, সমকালীন কাব্য সতীর্থ থেকে পৃথক। আধুনিক কবির রোমান্টিক গীতি ধর্মিতার চেয়ে মহাকবির ক্লাসিক ধৈর্য্ তাঁর মানস গঠনে বিশিষ্টতা দিয়েছে তাই প্রতিটি গ্রন্হের জন্য একটি পৃথক এবং সামগ্রিক চেতনা ধারনে তিনি তৎপর। একটি কাব্যগ্রন্হের জন্যে সামগ্রিক চেতনা রূপায়ন আধুনিক বাংলা কাব্য পরিত্যাগ করেছিল- কবি মানিক বৈরাগী তা পুনর্বিবেচনা করেছেন। কবি মানিক বৈরাগীর কবিতার মৌল প্রবণতা তার ইতিহাস চেতনা মহাকালের ইশারা থেকে উৎসারিত যে সমাজ সময়চেতনা – সে সময়ের মধ্যে সংস্হাপিত মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব এবং পরিণতি লিপিবদ্ধ করা। কবি মানিক বৈরাগী যে কারনে আলাদা সেটি হল- এ জনপদের ভয়াল শ্বাপদ রূপের পাশাপাশি সম্ভাবনাও তিনি আবিস্কার করেছেন। চিত্রের যেদিকটি আবিস্কার করেছিলেন এস,এম সুলতান- কবি মানিক বৈরাগী তাঁর কবিতায় সেই কাজটি করেছেন। সুলতানের চিত্রকলায় আমরা পাই, কৃষি নির্ভর সমাজের পেশীবহুল মানুষ, সেই সময়ের সংগ্রামশীলতা। কবি মানিক বৈরাগীর কবিতা পড়ুয়ার পাঠ-অভিজ্ঞতাকে মাঝে মাঝে অতিক্রম করে যেতে চায়। মানিক বৈরাগী বৈচিত্র পিয়াসীমন, তাঁর একটি গ্রন্হ থেকে আরেকটি গ্রন্হ সৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে আলাদা হয়ে যায়। যদিও পরিণামের একটি লক্ষ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা মানিক বৈরাগী’র কাব্যগ্রন্হের নাম বিবেচনায় সে সত্য ধরা পড়েঃ ‘গহিনে দ্রোহ নীল’, ‘শুভ্রতার কলংঙ্ক মুখস্হ করেছি’, ‘নৈনিতালের দিন’, ‘শের এ মানিক বৈরাগী’ এবং এবারের বইমেলার চুড়ান্ত রূপায়ণের আত্বজ কাব্য বৃক্ষ ‘ ছাইস্বর্ণ অম্লজলে ‘। গ্রন্হটি আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।  বইটি উৎসর্গ করেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাংলার নদীমাতৃক কবি মোহাম্মদ রফিক কে। নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। বইটির ফ্লেপ লিখে কাব্যটি  সমৃদ্ধ করেছেন দরিয়া পাড়ের নিভৃতচারী কবি আলম তৌহিদ।
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক পরিবারের সন্তান মানিক বৈরাগী মূলত খেলাঘর আসর ও উদীচী শিল্পগোষ্টীর হাত ধরে কৈশোর বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। তার রচনার মধ্যে শিশুতোষ গ্রন্হঃ ‘ বন বিহঙ্গের কথা’, ‘ ইরাবতী ও কলাদান’ এটি ইংরেজী ও বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত হয়। তিনি সম্পাদনও করেন ছোট কাগজ ‘ গরাণ’।
কবির ক্ষেত্রে কোন বিবেচনা চুড়ান্ত নয়। মানব মনের বিচিত্রমুখী চেতনার সবটুকু সে ধারন করতে চায়। একই দর্শনে স্হিতি থাকা কবির ধর্ম নয়।

কবি মানিক বৈরাগীর কবিতায় জীবনযাপন লক্ষ্য করা গেলেও তাঁর হাহাকার তাঁর কাছে বর্তমানের মুল্য সর্বাধিক কারন তার মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যত নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। কবি মানিক বৈরাগী’র কাছে অতীতের যে মুল্য তা ইতিহাসের ধাম্ভিকতার মধ্যে রয়েছে। মানিক বৈরাগী মানুষের ক্রমিক উন্নতির সম্ভাবনার আস্হাশীল। কবিকে হতে হবে বর্তমানের প্রতি দায়িত্ববান এবং ভবিষ্যতের দ্রষ্টা।
পঞ্চম পর্বে বিভক্ত ‘ ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’ কাব্যগ্রন্হটি। যথাক্রমে ‘ চাঁদমারি বনে জোসনার প্লাবনে’, ‘ দীপ্র চেতনা পুড়ে সবুজ রশ্মিতে’, ‘ হায় ফেরারী জীবন’, ‘ পরাণ কাঁদে গহীন গাঙ্গে’, ও ‘ অবরূদ্ধ সময়ের কবিতা- ধরিত্রীমাতার আহবান’,। সব মিলিয়ে উনাশিটি কবিতার সমাহারে অনন্য মাত্রায় অভিযোজিত হয়েছে। স্বোপার্জিত অভিঞ্জতা, স্বতন্ত্র মনোভঙ্গি কাব্যটিকে নিশ্চয় পাঠকের দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভে অভিষিক্ত করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
মানুষের জীবনে খন্ড় খন্ড় অভিজ্ঞতার সমাবেশ। সেই সমাবেশে নানা রঙ – আনন্দ, বেদনা, সুখ ও দুঃখের অনির্বচনীয় এক অনুরণন। সময়ের ক্যানভাসে এইসব অনুরণন নানা বর্ণবিভায় উদ্ভাসিত হয়। তেমনি ‘ ছাইবর্ণে অম্লজলে’র কাব্যগ্রন্হের ‘ বসন্তের বুনো রাতে’ কবিতার প্রথম স্তবকটি গভীর আবেগে একবার পড়তে চাই-
‘ বসন্তের গভীর রাতে মুখোমুখি দুজনে
চোখে চোখ রেখে গলা ডুবিয়ে পান করবো’।
কবি মানিক বৈরাগীর প্রেম ও বিদ্রোহের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং তা একই উৎসের দুই পরিপূরক প্রতিভাস। যে আন্তর – প্রেরণায় তিনি অধরা নারীকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, ব্যর্থতায় হয়ে পড়েন বিষন্ন, সেই একই প্রেরণায় সত্য-সুন্দর-মঙ্গল প্রতিষ্টায়, স্বাধিকারের বাসনায় তিনি উচ্ছারণ করেন প্রেমের অমুল্য বাণী। প্রেমের অঙ্গনে অধরা নারীর জন্য নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হয়েছে কাব্যচর্চার প্রারম্ভ থেকেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন স্পর্শ করতে পারেন না রহস্যময়ী অপরিচিতার শাড়ির আঁচল, তেমনি পারেন না কবি মানিক বৈরাগীও। কিন্তু এতকাল এই ব্যর্থতার জন্য তাঁর তীব্র হাহাকারবোধ নেই বরং অভিঞ্জতালব্দ- দর্শনাশ্রিত হয়ে আবিস্কার করেছে প্রেমের শ্বাশত-সত্য। অপ্রাপ্তির যন্ত্রনার জন্য এখন আর হাহাকার নেই, নেই ব্যাকুলতা কিংবা বেদনার অলজ্জ চিংকার- বরং এখানে পাই তত্বলোকের উত্তীর্ণ হবার প্রশান্ত প্রতীতিঃ
‘ হাসপাতালের বেড়ে ব্যথাতুর দেহ
সচল মস্তিস্ক নিয়ে যায় ব্যাবিলনে
মনে পড়ে শামস কাবরিজি,
মনে পড়ে রুমির জীবন,
রুমিও চরম নিঃসঙ্গ ছিল,
গড্ডালিকা সমাজ প্রিয় পুত্রকে রেখেছিল দখলে’।
মৃত্যুচেতনা রোমান্টিক কবির স্বভাব লক্ষণ। ‘ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’ কাব্যের ‘আমি মানুষ, দাস না’ কবিতায় মানিক বৈরাগীর এই বেঁচে থাকার লড়াই ধরা পড়েছে। তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্হ। তারপরও ভুলেন নি হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে রুমির নিঃসঙ্গ জীবন। পাঠকের আনুগত্য ও আকর্ষণ কেবল একজন কবির সৃষ্টিকর্মের মান ও উৎকর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং তাঁর জীবনাচার ও বিচিত্র বহুমুখী কর্মকান্ড় ও পালন করতে পারে একটা বড় ভুমিকা। কারণ, লেখকসত্বা কেবল লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি লেখকের জীবন ও সৃষ্টির ওপর যেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তেমনই পারে পাঠকের অন্তর্গত কৌতুহল ও আকর্ষণকে আনুগত্যের নিগড়ে বাঁধতে। নন্দিত ও নিন্দিত লেখক মানিক বৈরাগী তেমনই একজন, যিনি জীবদ্দশায় ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে দুইবার হামলায় পতিত হন। জোট শাসনামলে কারাবরন করেন। তারপরও সত্যকে মিথ্যার মোড়কে আবদ্ধ করেন নি। এখানে কবি প্রজ্ঞাশাসিত এবং অভিজ্ঞতালদ্ধ মানসতার স্পর্শে এসে হয়ে উঠেছে সংঘত, সংহত এবং শূন্যতা তথা বেদনার প্রতীকি- ধারক। যেমনঃ
দৃশ্যত মাসউদ শাফি আজ আর নাই
আমিও আর রাতের সমুদ্রের রূপ দেখি নাই’
প্রকৃতির কবিকে প্রতীক রূপে ব্যবহার না করে চিত্তলোকে ঠাই দেওয়া একজন কবির আজন্ম স্বভাব। কবি মানিক বৈরাগী ‘ ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’ কাব্যের ‘ঘুমনগর’ কবিতায় সমুদ্র যাপণের নষ্টালজিয়ায় সিক্ত হয়েছেন অকাল প্রয়াত কবি মাসুদ শাফির সাথে। জিকিরে জিকিরে কবির সত্বা প্রকাশ বিশেষ লক্ষনীয়।  কবি মানিক বৈরাগীর কবিতা অনেকাংশে সরল, আধুনিক জটিলতা যা এসেছে তা সরলতাকে অবগাহন করতে যেয়ে। তাই জীবনান্দীয় যে নগর জটিলতাঃ ‘কখনো যেন আমাদের মনও নিজের নয়’, কিংবা কবি শামসুর রহমানের মায়ের কাছে অচেনা ভদ্রলোকের যে মানসিক নির্মিত প্রতিকৃতি।
আমাদের সময়ের বহুমাত্রিক আলোকমানুষ কবি মানিক বৈরাগী। এই কবির কাব্যমানসে রয়েছে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষের সমীকৃতি ও প্রতীতি। কবিরূপে বহুল নন্দিত তিনি। এই অসাম্প্রদায়িক কবি সমকালিন জাতীয় পর্যায়েও এক তাৎপর্যপূর্ন কারুকৃৎ। চৈত্রের দুপুরে জলের তৃঞ্চায় কবি কিছু চাননা। হৃদয় যদি স্পর্শ করে হৃদয়, তবে কবি পৃথিবীতে উৎসর্গ করতে পারেন তাঁর ‘কবি বন্ধু’র জন্য। কবি প্রশ্ন করে খুঁজতে থাকেন, ভাত না ভালোবাসা মানুষের মৌলিক সমস্যা? কবি সন্দিহান তিনি কার জগতে বসবাস করেন। তাই তিনি অকপটে বলেন-
‘ মানুষ প্রাণী দিয়েছে মায়াবী যাতনা
কারনঃ আমি মানুষ ভালোবাসি’
কবি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চান সমগ্র ধরায়, কারনঃ তিঁনি ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভালোবাসা দিতে গিয়ে বারবার প্রতারিত হয়েছেন মানুষের কাছে। যখন ব্যর্থতা স্পর্শ করেছেন তখন তিনি বেদনাহত হৃদয়ে উচ্ছারণ করেছেন ‘আমি মানুষ ভালোবাসি’। ‘তুল্যমূল্য’ কবিতায় শাশ্বতিক বিরহকে তিনি আবিস্কার করতে পেরেছেন বলেই উপলব্দি করেছেন ‘মানু্ষ মানুষের জন্য’। তাই কবি মানিক বৈরাগী বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রেমের জগত প্রাপ্তি নয়, বরং অপ্রাপ্তি- মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য,শাশ্বত প্রাপ্তি।
প্রত্যেক মহৎ কবি তাঁর নিজস্ব রাজধানীর সঙ্গে গভীর বিজড়িত থাকেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মেই তাঁর নিজস্ব নগরের একটা বিশেষ রূপ ধরা পড়ে – যা স্বতন্ত্র্য প্রাতিস্কিতায় অতুলনীয়। প্রত্যেক কবিতারই থাকে একটা নিজস্ব চরিত্র, স্বতন্ত্র্য, জলবায়ু, আলাদা বৈশিষ্ট, চাল-চলন,যানবাহন,খাবার-দাবার, স্বতন্ত্র্য ভুগোলের অবকাঠামোর কবিতার চালচিত্র তাঁর আত্মার এ স্বরূপ আমরা চিত্রিত দেখি- তার প্রকাশিত কাব্য ‘অম্লস্বর্ণ ছাইজলে’। কবির চুড়ান্ত শব্দ- ভালোবাসা। ভালোবাসার আলো-আঁধারী পথে চলতে গিয়ে কবি মানিক বৈরাগী নিরন্তর নিজেকে ভাংচুর করে প্রবলভাবে নিজেকে তৈরী করেন। বারবার ভালোবাসার শীৎকারে কাতর হয়ে তেলাওয়াত করেন ইবাদতের স্বাদ মন ও মননে। কবি মানিক বৈরাগীর ‘তেলাওয়াত’ কবিতার শেষ স্তবক একবার তেলাওয়াত করতে চাই পরম পবিত্রতায়।
‘ তুমিই আমার আখের জাহান
তোমাতেই করি ইবাদত….
তোমাতেই তেলাওয়াতে আল কোরআন’
কবির মানসলোকে তেলাওয়াতের ধরণ ভিন্ন হলেও এ কবিতায় ইবাদতের পরমসত্য অনন্ত-মধুর রূপে গ্রহন করেছেন এবং সমস্ত জাহানের সৌন্দর্যসন্ধানকেই আপন কবিসত্তার মৌল ব্রত। সাহিত্য অঙ্গনে শাশ্বত পরমার্থকে আবিস্কার, নিজস্ব প্রকৃতিবোধ এবং গীতল কাব্যরস সৃজনে কবি মানিক বৈরাগীর ‘ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’ একটি বিশিষ্ট কাব্য। কেবল ভাবগত দিক থেকেই নয়, প্রকরণ- প্রকৌশলের দিক দিয়েও একথা সমান প্রযোজ্য। বিষয়ানুগ ভাষা-ব্যবহার, উপমা- রূপক- উৎপ্রেক্ষা ও সমাসোক্তি অলন্কারের শিল্পিত সৃজন এবং ভাবের অন্তরাশ্রয়ী গীতোময় গতিবেগে ‘ ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’ কাব্য মানিক বৈরাগী- কাব্যধারার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নির্মাণ।

May be an image of 6 people, people sitting, people standing and food

 মানিক বৈরাগীর কবিতা – মানুষ সিরিজ

পিতা

পিতা তোমাকে নিয়ে
একটি কবিতা রচনার আবদার রক্ষা করতে পারছি না।
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
রাসেলের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি।

পিতা তোমাকে নিয়ে
ডামাডোলের ভেতরে ঠাঁই নিয়েছে শকুন শাবক
কলকল নদীর স্রোতের মত শনশন নির্মল বায়ুপ্রবাহের মত
একটি রচনার আবদার রক্ষা করতে পারছি না
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
সদ্য র‌্যাংকপ্রাপ্ত উজ্জ্বল উচ্ছল জামালের মুখ
নিমিষেই বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে ভয়ার্ত শব্দে
রক্তনদী বয়ে যায় মধুমতীর দিকে

পিতা তোমাকে নিয়ে
যখনই কলম হাতে বসি সুবেহ-সাদিকের পরে কোথা হতে আমার চোখে ভাসে
উত্তাল উদ্দাম পৌরুষদীপ্ত কামালের মুখ

পিতা তোমাকে নিয়ে
কোমলে কঠিন একটি কাব্যনাট্যের আবদার রক্ষা করতে পারছি না
তোমারই শতবর্ষ আয়োজন স্মারকের জন্য
যখনই কলম হাতে বসি কোথা হতে আমার চোখে ভাসে মাতৃজন্মের আর্তনাদ,
সদাশান্ত মুক্তিচেতনায় অবিচল মমতাময়ী রেণু’মার মুখ।
এই শতবর্ষে তোমার নামে তোমার জন্য
কোন মঙ্গলকাব্য রচনার অক্ষমতা ক্ষমা করে দিও পিতা।

তুমি জননীর জননী- দিব্যমাতা

জননী ধরিত্রী সর্বংসহা মা আমার
অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, অনার্য, আর্য আরও আরও কতো
বাঙময় বাঙাল, বাঙ্গালী, জাত-উপজাত
আদী-অনাদি জাতিগোষ্ঠীকে
তোমার পবিত্র আচঁলে ধারণ করে,
কত সন্তানের আঁচড়ের আঘাত সয়েছো অনায়াসে

হাজার বছরের যমুনা-বিপাশা-গঙ্গা-পদ্মা-কর্ণফুলী,
মেঘনা-মাতামুহুরি হয়ে মধুমতীর তীরে তোমার আবির্ভাব
জন্মতে থিতু হয়ে তোমারই জন্মাবাস
তারপর খরস্রোতা মধুমতীর মতো
কখনো খুব ধীর কখনো অস্থির, কখনো সুস্থির শীতলক্ষা হয়ে
ঘাট থেকে ঘাটে, অবশেষে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধানমণ্ডি।

শৈশবেই হারিয়েছো জন্মদায়িনী মা জন্মদাতা পিতা
লুৎফর-সায়েরা আমার প্রপিতামহ-মাতা কখনো তোমার
ভরসা, ভালোবাসা, মমতার এতটুকু অভাব অনুভব করতে দেয়নি
তুমি জননীর জননী- দিব্যমাতা।
আমার সেই প্রপিতামহ-মাতা জানতেন,একটি ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর জন্য
আপনাকে সর্বংসহা জননীর আসনে অধিষ্ঠের প্রয়োজন।

সর্বজয়া সর্বংসহা বেহুলা রেণু মা আমার
তুমি আগলে রেখেছিলে তোমার খোকাকে
তুমি আগলে রেখেছিলে হাসিনা-রেহেনা, কামাল-জামাল-রাসেলকে
তুমি আগলে রেখেছিলে আদরের ভাই-দেবর শেখ নাসেরকে
তুমি আগলে রেখেছিলে বৌমা আরজু মণি-রোজিকে
কিন্তু তোমার বুক বিদ্ধ করে ঘাতকের নির্মম বুলেট যখন
এফোঁড় ওফোঁড় করে প্রাণপাখিটাকে উড়িয়ে দিল
তখন সব যেনো তোমার আঁচলহারা হয়ে আকাশে আকাশে
একজন একজন করে উড়তে থাকলো!

এক এক করে উড়তে থাকলো তোমার প্রিয়তম খোকা,
তোমাদের আদরের কামাল-জামাল-রাসেল
মা, রেণু মা আমার, আমরা পারিনি তাদেরকে আগলে রাখতে
আমরা পারিনি, সেই ভোররাতের প্রথম প্রহরে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

রবি দা

তুমি এখনো দারুণ সমারোহে আমাদের রমণীকুলের কাছে অসাধারণ প্রৌঢ় যুবক। আকর্ষণীয় প্রেমিক পুরুষ। এই গভীর সত্য আবিষ্কার করি যখন আমার বউ কাজের ভেতর রবি দা’র গান গুনগুনায়।

তখন আমার রবি দা’কে খুব ঈর্ষা হয়। ঈর্ষা হয় বউ যখন গোল কোর্তা পড়া দাঁড়ি গোফওয়ালা বুড়োর ছবিটি যত্ন করে ঝাড়ামুছা করে। দেখি, তার হৃদয়ের
সমস্ত ঐশ্বর্য ঢেলে দিচ্ছে এক দাড়িওয়ালা সন্তের ছবিতে। ছবির কথা ওঠতেই
মনে পড়ে-একবার বলেছিলে ‘তুমি কি কেবল ছবি/শুধু পটে আঁকা’। আমি বলি-
রবি দা তুমি কেবল ছবি নও, ছবির ভেতর এক মহান কবি।

সে যখন গীতবিতানকে অন্যসব বই থেকে আলাদা করে রাখে, অবসরে ছোট গল্প সমগ্র, গল্পগুচ্ছ নিয়ে বসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে গভীর মনোযোগে, তখন খুব হিংসে হয়। তার পাঠের একাগ্রতার ভেতর আমি যেন অনস্থিত্ব এক সত্তা। যুথবদ্ধ আমাদের সংসারে রবি দা’র কবিতা-গান-গল্প আমাকে নিয়ে যায়
আরো দূর একাকীত্বের প্রান্তরে।

আজো বাংলার সুকণ্ঠি শ্যামল মেয়েরা তোমর গানের রাগ-রাগীনিতে
বিভোর হয়ে থাকে। আর আমার বউ মজে আছে ‘শেষের কবিতা’য়।

এখন তাকে আমার লাবণ্য লাবণ্য লাগে। রবি দা, বলো তোমাকে ঈর্ষা না করে উপায় আছে !

জীবনানন্দ দাশ

স্যার আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন,
ক্লাসে আসতেন উদাস মুখে,
পুরুল্যান্সের চশমা খোলে চোখ মুছতেন।

স্যারকে আমরা কেউই মান্য করতাম না,
স্যার ওসবের ধার ধারেন না।
আমাদের বকাও দিতেন না।
আমরা যারা একদম পেছনে বসে তাস খেলতাম,
স্যার দেখেও দেখতেন না।
স্যারকে মনে হতো পৃথিবীর একমাত্র নিরীহ-নির্জন প্রাণী,
দুনিয়ার তাবত দুঃখ ও হতাশার বোঝা একাই বয়ে বেড়াচ্ছেন।

তাই তিনি আমাদের কোলাহল, তাসখেলা,
সামনের বেঞ্চের কমলার সাদাপাড়ের শাড়িতে
ফাউন্টেন পেন এর কালি লাগিয়ে দেয়া সব দেখতেন।
কিন্তু ভয়ে বা আদরে কিছুই বলতেন না।

একসময় কিছু লেসন বলে নিরবে প্রস্থান করতেন।
স্যার এমন ভাবে হাঁটতেন
পায়ের চাপে ঘাস যেনো ব্যথা না পায়।
ডানে বায়ে তেমন তাকাতেন না,
আকাশের দিকে এমন ভাবে তাকাতেন
যেনো সূর্যকে গলিয়ে তারা গুনবেন।

একদিন আনন্দবাজারে সিঙ্গেল কলামে
স্যারের পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ
ট্রাম দুর্ঘটনায় এক কবির মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে
নিউজ বেরুলো।

নিউজের আদ্যোপান্ত পড়লাম,
আমি খেলা ও বাজারের খবর ছাড়া
অন্য কিছু পড়িনা বা প্রয়োজন বোধ করিনা।

এরপর ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম,
আমার চোখ বাষ্পীভূত হলো অপরাধে,
শ্রদ্ধায়।
যখন জানলাম তিনিই কবি জীবনানন্দ দাশ।

উত্তরের জলপাই বনে

পচন ধরেছে ডাইনে আর বামে
পচন ধরেছে চেতনাদর্শের আস্তাবলে
পচন ধরেছে ক্ষমতার খোয়াড়ে, অলি – গলির অলিন্দে
ক্লীব কর্তার ধ্বজভঙ্গ শিবদন্ডও খাঁড়ায় কামজ্বরে
বাৎস্যায়নের দ্যাশে দ্রুত বীর্যপতন রোগের উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে
আগাম বসন্ত বাতাস বইছে উত্তরের জলপাই বনে
মালী – মালীপ্রধানেরা উফশী অগ্নিবীজ শোকাচ্ছে রোদে
বহুদিন নাড়াচাড়া হয়নি, মরছে পড়েছে জলপাই লাঠিতে
কতোদিন তারা শীতঘুমে ছিলো, খায় আর ঘুমায় কর্তার আদেশে
এভাবে অলস দেহে মেদ জমেছে, জং পড়েছে লৌহ- দেহের কলকব্জায়।

জলপাই চাষা,মজুর, মালিদের দক্ষতা – সক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে
পূর্ব-উত্তর মেঘনা – গোমতীর চরে নয়া – উপনিবেশিক চাষাবাদের কর্ম – কৌশলের
অতিব গোপনীয় উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কর্মশালা, ফিসফাস, চুপচাপ বৈঠক চলছে
সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক জমিনে গবেষণালব্ধ জলপাই অগ্নিবীজের ফুলকি ফুটবে ।
সংঘবদ্ধ জলপাই অগ্নির সমুখে পুড়ে যায় সংবিধান, আইন, আদালত, বিচারক।

জলের কুচকাওয়াজ

খিড়কির ফাকগলে বৃষ্টিভেজা কিরণ
আসে শ্রাবণ মুখর প্রভাতে
মেঘাশ্রিত ধোঁয়াশে আলোয় আকাশ যেনো কাঁদছে
কবিতার খাতারা আজ বড়ো বিষন্ন
মধ্য শ্রাবণের মেঘে ঢাকা পূর্ণিমা চাঁদের কিরণও ভূতুড়ে বিবর্ণ
কান্নারত বৃষ্টিরা প্রভাতের আলোয় খুব ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত

বিষন্ন – বিষাদ ধীরেধীরে ঘুণপোকার মতো
চুষে নিচ্ছে উচ্ছ্বাসের অনুরনন
কোথাও কারা কোন কোন খোয়াড়ে পদধ্বনি শোনা যায়
জলের কুচকাওয়াজ
সারারাত তাদের উপর খুব দখল গেছে
মেঘনা-গোমতির খরস্রোত আজ থেকে গতিহারা।

ফরিয়াদ

কামীনি- কাঞ্চনের পুষ্পমঞ্জুরিত রজনী আমার
নিশি – কানন বিছানা যাপন কে ব্যাথা-বেদনায়
নরক উদ্যান করোনা প্রভু।
প্রভু কুমার তোমার গড়া মাটির কায়া টি
কারণে অকারণে ঘাত-প্রতিঘাতে ভেঙেছে ভাঙ্গিয়াছ বারবার
পাপে- তাপে চাপে -চিপায় রূহ খানা আর সইতে পারছেনা বিগত পাপের যন্ত্রণা
বিনিময় নাও মধুময় প্রাণভোমরা, তবুও রূহ কে দাও রেহায় খোদা।

গোলাকার দুনিয়ায় একপাশে আলো, অন্যপাশে…

সেই কবে! অন্তত তিরিশ বছর হবে
আমার মুখমণ্ডলে সদ্য কোমল দাড়ি- গোঁফ
উজ্জ্বল – শ্যামবর্ণের লিকলিকে শরীর
একবছর সিনিয়র ক্লাসে, ক্লাসের অবসরে আন্তরিক আড্ডা
আড্ডার মাঝে ধুমসে সিগারেট ফুকছে, আর
উর্ধ্বাকাশে ধোঁয়ার রিঙের মত আধুনিক মমনবিদ্যার দর্শন উড়াচ্ছে
তার রূপজৌলুশে কাস্মীরীকন্যার অধরযুগল সিগারেটের নিকোটিনের রঙে শিহরিত কালো প্রলেপ

তারপর আরবার দেখা হলো, গোলাকার দুনিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্র সৈকতের বিশাল জলরাশির সামনে
আমি একা, সে পরিবার সমেত বোরখায় আবৃত
কোন এক ইসলামি ব্যাংকের কর্মকর্তার ঘরণী আজ
তবুও সে আমাকে চিনেছে, মনে রেখেছে
তারপর তারপর
তার আর পর নেই।

লেখক : কবি,শিশুতোষ গল্পকার, নব্বইয়ের প্রগতিশীল নির্যাতিত ছাত্রনেতা কক্সবাজার, বাংলাদেশ।

মানিক বৈরাগী
কবি, শিশুতোষ গল্পকার, প্রাবন্ধিক।
পিতা – সালেহ আহমেদ
মাতা – হাবিবা খাতুন
জন্ম – ২৮ জানুয়ারি ১৯৭১
শিক্ষাগত যোগ্যতা – সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স অসমাপ্ত ( রাজনৈতিক কারণে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা – লেখালেখি
গ্রামের বাড়ি – সিকলঘাটা, লক্ষ্যারচর,চকরিয়া।
বর্তমান ঠিকানা – বিমানবন্দর সড়ক, পূর্ব নতুন বাহারছড়া, পৌরসভা, কক্সবাজার।
মোবাইল – ০১৮১৮৫৯৩২৫৩
ইমেইল –suamanik1971@gmail.com
প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা – প্রকাশিত গ্রন্থ
#কবিতা
গহীনে দ্রোহ নীল
শুভ্রতার কলঙ্ক মূখস্ত করেছি
নৈনিতালের দিন ২০১৯
শের এ মানিক বৈরাগী ২০২০
ছাইস্বর্ণ অম্লজলে ২০২১
মৃত্যুর গান গাই ২০২২
একলব্যের আঙুল – ২০২২
#প্রবন্ধ
বুবু থাকুন নিরাপদে ২০২১

#শিশুতোষ গল্প
বন বিহঙ্গের কথা ( বইটির ভিডিও চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং এন টি ভি তে প্রচারিত হয়েছে)
ইরাবতী ও কালাদান ২০২০ ( ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত)
ডোলবাতি ২০২১ ( বইটি ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত)
ঝিনুক ও জলমাতা। ২০২২
সম্মাননা – মূল্যায়ন সাহিত্য সম্মাননা, বঙ্গবন্ধু জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা, অন্তরা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কতৃক গুণিজন সম্মাননা, দরিয়া নগর আন্তর্জাতিক কবিতা মেলা ২০২২এ কবিতা বাংলা কবিতা ও সামগ্রিক সাহিত্য সম্মাননা ২০২২ ভূষিত হয়েছেন।
সম্পাদক – গরাণ ( ছোট কাগজ)
সম্পাদক – পিতা ( বঙ্গবন্ধু স্টাড়িসার্কেল এর মুখপত্র)

874 ভিউ

Posted ১১:৫৮ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com